খবরযোগ মতামত :
সংবিধান নিয়ে আমাদের দেশের পড়ালেখা জানা লোকজনের মধ্যে সম্ভবত সবারই একটা না একটা মতামত আছে। রাজনীতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করে এরকম মানুষদের মধ্যে খুব কম লোকই পাবেন যারা সংবিধানে অন্তত কোনো না কোনো একটা বিধান পাল্টাতে চান বা যোগ করতে চান বা বাদ দিতে চান।
মাঝে আমাদের মধ্যে আবার কয়েকজন পাবেন যারা পুরো সংবিধানটাই পাল্টে ফেলতে চান। এইরকম একজন ছিলেন আমাদের আহমদ ছফা। ছফার মৃত্যুর বেশকিছু বছর আগের ঘটনা। তখন তিনি আজিজ মার্কেটের দোতলায় একটা দোকান নিয়ে অফিসের মতো বানিয়েছিলেন।
একদিন গিয়েছি ছফার আড্ডায়, সেদিন আমার সাথে ছিলেন আমার বন্ধু ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান আর আমরা দুইজনই তখন ড. কামাল হোসেনের ফার্মে কাজ করি। কথা প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নাম উঠতেই ছফা বললেন, কোনোদিন দেখা হলে আমি ড. কামালকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘আপনি কি বাংলাদেশকে একটা মামলা মনে করেনথ? এরপর তিনি ড. কামাল হোসেনের কর্ম, অর্থাৎ তার নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানের ত্রুটি বলতে লাগলেন। আমরা কিছুক্ষণ কৌতূহল নিয়ে শুনলাম সংবিধান নিয়ে ছফার সেই বিচিত্র সব চিন্তা।
আগস্ট অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটার পর সংবিধান নিয়ে যে সর্বত্র আলাপ আলোচনা নতুন উদ্যমে শুরু হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। দেশে এখন সবাই সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছে সংবিধান সংশোধন বিষয়ক সুপারিশমালা প্রস্তুত করার জন্য।
ঢাকায় নানা মানুষ, নানা সংগঠন সভা ইত্যাদি করছেন কীভাবে সংবিধান সংশোধন করা যায় তা নিয়ে আলোচনার জন্য। এইসব আলোচনায় বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন থেকে শুরু করে টুকটাক ছোটখাটো সংশোধনসহ নানারকম প্রস্তাব উপস্থাপনা করছে সবাই। একদম হাস্যকর প্রস্তাব থেকে শুরু করে বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে এইরকম নানা প্রস্তাব করছে লোকে।
সবকিছুরই ইতিবাচক দিক আছে নিশ্চয়ই। সংবিধান সংশোধন এমনিতে খুব একটা অভিনব কোনো বিষয় নয়, সংবিধান হচ্ছে এমন একটি দলিল যেটা সময়ের সাথে সাথে মাঝে মাঝেই সংশোধনের প্রয়োজন হয়। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আমি নিজেও বিদ্যমান সংবিধানে বেশ কয়েকটা বিষয় পরিবর্তনের সুপারিশ করবো। সেই অর্থে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনা নেতিবাচক কিছু নয়-ভালো কথা। সরকারে যেই থাকুন, এইরকম অনুশীলন হওয়া ভালো, এটার দরকার আছে। কিন্তু সংবিধানে কোনো সংশোধনের প্রস্তাব করার আগে বা সংবিধানে হাত দেওয়ার আগে কয়েকটা বিষয় মনে রাখা দরকার।
প্রথমে যেটা মনে রাখতে হয়, সংবিধান নামক দলিলটা গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল—আমাদের সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে যে রকম বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইনথ; ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিথ কথাটি লক্ষ্য করুন। কোনো সংবিধানে এটা উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক, সংবিধান সব দেশেই সেই দেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিই হয়।
অন্য ভাষায় বললে, রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক সংগঠনটি কী ধরনের হবে, সেখানে রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্ক কী রকম হবে এবং রাষ্ট্রের সাথে ও রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের সাথে জনগণের সম্পর্ক কী হবে সেই সংক্রান্ত সব বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত থাকে সংবিধানে। একটা রাষ্ট্রে তো অনেক মানুষ থাকে, আমাদের দেশে যেমন কমবেশি প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বাস। এই সতেরো কোটি মানুষ তো আর সবাই শলাপরামর্শ করে তারপর সংবিধান লিখবে না—সেটা বাস্তবে খুবই জটিল এবং কার্যত অসম্ভব একটা কাজ।
তাহলে সংবিধান জনগণের ইচ্ছার অভিব্যক্তি হবে কী করে? জনগণের পক্ষে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বসে আলাপ আলোচনা করে সংবিধান লিখতে হয় বা সংশোধন করতে হয়। অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধন এই কাজটা করতে হয় জনপ্রতিনিধিদের। দশজন পণ্ডিত ধরনের মানুষ, ধরেন খুবই বড় বড় দশজন বা বিশজন পণ্ডিত, ওরা মিলে হয়তো চমৎকার একটা সংবিধান লিখে ফেললো—সেটা বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে মেনে নেওয়া যাবে? যাবে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলে আপনাকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছেই যেতে হবে।
তার মানে এই নয় যে, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বা এই সরকার যে কমিশন গঠন করেছে সে রকম কোনো কমিশন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারবেন না। নিশ্চয়ই পারবেন। যে কেউই বলতে পারেন যে আমি এইরকম সংবিধান চাই বা ওই রকম সংবিধান চাই বা সংবিধানে আমি এইরকম বিধান চাই বা সেই রকম বিধান চাই ইত্যাদি।
এখন যেসব আলোচনা হচ্ছে সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে আপনি দেখতে পাবেন যে, নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যার যার মনের ইচ্ছা অনুযায়ী নানারকম বিচিত্র সব প্রস্তাব করছেন। কিন্তু সংবিধানে কোন বিধানগুলো স্থান পাবে, কোন প্রস্তাব অনুযায়ী হবে সেটা নির্ধারণ করতে পারেন কেবল জনপ্রতিনিধিরা। আমরা যারা যতই পরামর্শ দিই, মতামত দিই, সেগুলোও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পর্যায়ে কেউ না কেউ বিবেচনা করবে, কোনো কোনো আইডিয়া নিয়ে কেউ এগিয়েও যেতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে পার্লামেন্টে, জনপ্রতিনিধিদের সভায়।
কেননা রাষ্ট্রের জন্য একটা সংবিধান সেটা তো আর একজন বা কয়েকজন ব্যক্তির ইচ্ছা হলেই পরিবর্তন করা যায় না। বর্তমানে যেহেতু নির্বাচিত জাতীয় সংসদ নেই, আমরা চাইলেও সংবিধান সংশোধন করতে পারবো না। কেবল প্রস্তাবগুলো প্রস্তুত করতে পারবো।
সংবিধান সংশোধন যখনই হোক, খানিকটা আশাভঙ্গের ব্যাপার যেটা, এই পর্যন্ত যেসব সম্ভাব্য পরিবর্তনের কথা ঘুরে ফিরে গণমাধ্যমে এসেছে, সেগুলোর এমন কোনো প্রস্তাব এখনো আমার চোখে পড়েনি যেগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে বা যেগুলো গণতন্ত্র বজায় রেখে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
যারা সংবিধান নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব করছেন, সেগুলো দেখলে মনে হয় এরা যেন ওদের সামনে যেসব সমস্যা ওরা দেখছেন, সেই সমস্যারই একটা সমাধান সংবিধানে যুক্ত করতে চান। যেসব সমস্যার সমাধান ওরা ওইরকম একটা দুইটা বিধান যুক্ত করে দিয়ে অর্জন করতে চাইছেন, সেইসব সমস্যা আসলে সংবিধানের কোনো বিধানের কারণে বা বিধান না থাকার কারণে হয়নি।
কিছু কিছু সমস্যা আছে, যেমন নির্বাচনে কালো টাকা, দুর্নীতি, মনোনয়ন বাণিজ্য এইরকম, এগুলো আসলে সাংবিধানিক সমস্যা নয়, বরং সংবিধানে যেসব বিধান আছে সেগুলো ঠিকঠাক মতো বাস্তবায়ন না করা বা অনুসরণ না করা। কেউ কেউ আবার সংসদের ধরন পরিবর্তন করে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করতে চাইছেন কিন্তু এটা ভাবছেন না যে, ওইরকম একটা দ্বিতীয় কক্ষ আসলে নির্বাচিত হয়ে আসতে অক্ষম কিছু ব্যক্তিকে সংসদে উচ্চ কক্ষে স্থান দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো অর্থবহ লাভ কি হবে?
আপনি কল্পনা করুন তো, যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হতো তাহলে আওয়ামী লীগের সময় দ্বিতীয় কক্ষে কারা বসতো? ওরা কি আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারতো? নাকি ঠেকাতে চাইতো?
মূল সমস্যাটা অন্যত্র, যেটা সমাধানের জন্য বিদ্যমান সংবিধানের কোনো পরিবর্তনেরই প্রয়োজন হয় না। যারা সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার নিয়ে নানা প্রস্তাব দিচ্ছেন এরা অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেননি যে, আমাদের সংবিধানে দুইটা অনুচ্ছেদ আছে, অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০, যেগুলো অনুযায়ী আমাদের দেশের প্রতিটা প্রশাসনিক ইউনিট নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার শাসন করবে, ওদের হাতে থাকবে বেসামরিক প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
সংবিধান বলছে যে, নিজেদের এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য স্থানীয় সরকার যেন তহবিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্য সংসদ আইন করে স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করবে। প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন যদি স্থানীয় সরকারের হাতে থাকে আর তার জন্য যদি স্থানীয় সরকারকে জনগণের পকেট থেকে টাকা নিতে হয় তাহলে তো সরকার চলে যাচ্ছে মানুষের হাতের মুঠোয়, মানুষের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে।
কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তখন ক্ষমতা কমে আসে, এক ব্যক্তি তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। আর স্থানীয় সরকারগুলো নির্বাচিত হলে দেখা যাবে যেসব রাজনৈতিক দলেরই সুযোগ থাকে কেন্দ্রে না হলেও কোনো না কোনো স্থানীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকবে—ফলে সার্বিকভাবে একটা রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হবে। পূর্ণ ক্ষমতার নির্বাচিত স্থানীয় সরকার থাকলে উন্নয়ন ও প্রশাসনে এমপিদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ থাকবে না, এমপিরা সেইসব থেকে টাকাও কামাতে পারবে না, তাহলে কালো টাকা খরচ করে তিনি এমপি হবেন কেন?
আমাদের যে সংবিধানটি রয়েছে—কিছু সংশোধনী সেটাতে দরকার আছে নিশ্চয়ই—কিন্তু সাধারণভাবে বলতে হয় যে, আমাদের মূল সংবিধানটি একটি চমৎকার সংবিধান, খুব বড় কোনো পরিবর্তন এতে প্রয়োজন নেই। যেসব সমস্যা আমরা মোকাবিলা করছি সেই ১৯৭৫ থেকে, সেগুলো হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ না হওয়ার ফল।
একটা কথা আছে, গণতন্ত্র যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে সেখানে আরও অধিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হয়—গণতন্ত্রের চিকিৎসা হলো অধিক গণতন্ত্র, আরও অধিক গণতন্ত্র। আমরা বারবার গণতন্ত্রে যেতে চাইছি আর বারবার একটা স্বৈরাচারী সরকার এসে চেপে বসছে। এটার চিকিৎসা কী? এটার চিকিৎসা হচ্ছে অধিক গণতন্ত্র।
সংবিধানের কোনো বিধানের কারণে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকরা স্বৈরাচারী হয় না, এটা হয় দেশে সর্বস্তরে গণতন্ত্র না থাকার ফলে সব ক্ষমতা যখন কেন্দ্রে এসে জড়ো হয়। আর সংসদীয় সরকারে সেটা প্রধানমন্ত্রীকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্ষমতা দেয়। যথাযথ স্থানীয় সরকার হলে তো কেন্দ্রে ক্ষমতা এমনিতেই কমে যায়।
কিছু সংশোধন যে সংবিধানে প্রয়োজন নেই সে কথা কেউ বলছে না। যেসব সংশোধনী আগে হয়েছে সেগুলোর পেছনে কোনো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল না, ফলে সংবিধানের যে মৌলিক চরিত্রের সাথে মেলে না এমন সব বিধান এসে সংবিধানে জুড়ে গেছে—সেইগুলো পরিষ্কার করার দরকার আছে। কিন্তু মৌলিক কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।
যেটার প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার আর গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা। সেটা তো সংবিধানে আছেই, সেটাই বাস্তবায়ন করুন। সেটা আমাদের সোশ্যাল ইন্টেলেকচুয়ালরা আর রাজনীতিবিদরা করতে দেবেন না, কেননা আমাদের দেশের মানুষের প্রতি ওদের কোনো সম্মান নেই।
এরা মনে করে যে দেশের মানুষ বোকাসোকা মূর্খ লোকজন। সাধারণ জনগণ-ওরা কি নিজেরা নিজেদের শাসন করতে পারবে? এইটাই সমস্যা, এই কারণেই গণতন্ত্র বিঘ্নিত হয়। সেটা দূর করুন, দশটার মধ্যে আটটা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সংবিধান সংশোধন করতে হবে না। অবশ্য যারা সংবিধানের মৌলিক চরিত্র পাল্টে দিতে চায়, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি পাল্টে দিতে চান, ওদের কথা আলাদা।
[ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]