দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কষ্টের অবসান হলো সন্দ্বীপবাসীর। শত বছর ধরে যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপটির অন্তত চার লাখ মানুষ। সব দুর্ভোগ দূর করে চট্টগ্রাম জেলার এ দ্বীপ জনপদে শুরু হয়েছে স্বপ্নের ফেরি চলাচল।
১৮ কিলোমিটার সাগরপথে বাণিজ্যিকভাবে ফেরি চালু হয়েছে আজ সোমবার (২৪ মার্চ)। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে এ সেবার উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
শত বছর ধরে উত্তাল সাগরপথে স্পিডবোট ও ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযানে চলাচল করতেন সন্দ্বীপের বাসিন্দারা। বিরূপ পরিবেশে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় ঘটতো প্রাণহানির ঘটনাও। কখনো কোমর পানি, কখনো হাঁটু পানি মাড়িয়ে ফিরতে হতো বাড়ি। বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো নারী ও শিশুদের। সূর্যাস্তের পর বন্ধ হয়ে যেত যোগাযোগ ব্যবস্থা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দৈনন্দিন কাজে ১৮ কিলোমিটার উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে জেলা শহর চট্টগ্রামে যাতায়াত করতেন এ জনপদের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ। এবার ফেরি চালুর মাধ্যমে সেই কষ্ট ঘুচবে দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দার।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন সন্দ্বীপের বাসিন্দা সংবাদকর্মী কামরুল হাসান। নাড়ির টানে বছরে অন্তত দু-একবার বাড়ি ফিরতে হয় তার। স্বপ্নের ফেরি চালুর এ দিনে বাংলাদেশ গার্ডিয়ান-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের আনন্দ অনুভূতির কথা জানিয়েছেন তিনি।
কামরুল হাসান বলেন, সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত, উচ্ছ্বাসিত। ফেরি চলাচল যাতে টেকসই হয়, সেই ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএকে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানাই।
তিনি বলেন, নিরাপদ নৌ রুট সন্দ্বীপবাসীর প্রাণের দাবি ছিল। একসময় এই দাবিকে কেবল স্বপ্ন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে এখানকার অতীতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। ফেরি চালুর মধ্য দিয়ে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এই ফেরি চলাচলের মাধ্যমে সন্দ্বীপ দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি ভূমিকা রাখবে।
উদ্বোধনের দিনে ফেরিতে থাকা সন্দ্বীপের আরেক বাসিন্দা মকবুল আহমেদ বলেন, ফেরিতে চড়ে বাড়ি যাবো- এটি আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
জহির উদ্দিন বলেন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে সন্দ্বীপ অবহেলিত ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করা লাগতো। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট হতো বেশি। এখন থেকে ঝুঁকিমুক্ত হলাম। আজ আমরা খুবই আনন্দিত।
জানা গেছে, প্রতিদিন যাওয়া-আসা মিলিয়ে মোট চারবার চলাচল করবে এ ফেরি। পারাপার করতে পারবে ২৫ থেকে ৩০টি প্রাইভেট কার কিংবা ১০ থেকে ১২টি বড় ট্রাক। উঠতে পারবেন ২৫০ থেকে ৩০০ যাত্রী।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে যেতে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লাগছে। জোয়ার-ভাটা হিসেব করে প্রতিদিন যাওয়া-আসা মিলিয়ে চারবার ফেরি চলাচল করবে। ফেরিতে ছোট-বড় ৩৫টির মতো যানবাহন পরিবহন করা যাবে। চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে বেশ কয়েকটি পরিবহন চলাচল করবে। ঢাকা ও গাজীপুর থেকে বিআরটিসির দুটি এসি বাস ফেরিযোগে সরাসরি সন্দ্বীপে যাবে।
ফেরি সার্ভিসের স্থায়িত্বের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্চ মাসের পর থেকেই ধীরে ধীরে সন্দ্বীপ চ্যানেল অশান্ত হয়ে ওঠে। এখানে জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির পার্থক্যও অত্যধিক। বর্তমানে ভরা কটাল ও মরা কটালে পানিস্তরের হ্রাস–বৃদ্ধি প্রায় ২১ ফুট পর্যন্ত হয়, যা দেশের অন্য কোথাও হয় না। জোয়ার-ভাটায় এ রকম বিশাল তারতম্যের কারণে এ চ্যানেলে ফেরি চালানো অনেক কঠিন হবে। এ পথ আমাদের দেশে উপকূলীয় চ্যানেলে প্রথম। ফলে কিছু সমস্যার মুখোমুখি তো হতে হবে। যেহেতু বর্তমান ফেরি এ অঞ্চলে চলাচলের উপযোগী নয়, তাই এপ্রিল মাস থেকে ফেরি চলাচল হয়তো বন্ধ রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ উপকূলীয় এলাকায় চলাচল উপযোগী ফেরি নির্মাণ করছে। আগামী বছর থেকে এ সমস্যা আর থাকবে না বলে আশা করা যায়। তবে এ চ্যানেলে পলি জমার হার অনেক বেশি। ফলে বারবার ড্রেজিং করা লাগতে পারে।
ফেরি কপোতাক্ষের মাস্টার সামশুল আলম বলেন, ফেরিতে ৬০০ জন মানুষ উঠতে পারবে। চলাচলের জন্য সাধারণ যাত্রী ১০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৯০০ টাকা, বাস তিন হাজার ৩০০ টাকা, ট্রাক তিন হাজার ৩৫০টাকা এবং ১০ চাকার গাড়ির জন্য ৭ হাজার ১০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।