খবরযোগ ডেস্ক: নতুন অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সম্প্রতি কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনকে নতুন বাজেট প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার নির্দেশ অনুযায়ী এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
আগামী দুই মাস ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বরাদ্দ নিয়ে সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। এরপর এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্পদ কমিটির বৈঠকে নতুন অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। ২০২৫ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবে। এবার যেহেতু সংসদ নেই, তাই নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করা হবে।
অর্থ উপদেষ্টা এমন একসময় বাজেট ঘোষণা করবেন, যখন সময়টা তার জন্য অনুকূলে নয়। নানা সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে বাজেটের কাজে হাত দিতে হচ্ছে তাকে। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির চাপ ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। ডলারসংকট এখনো কাটেনি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো স্বস্তিদায়ক নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো নয়। তার সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এমন কঠিন সময়ের মধ্যে নতুন বাজেট দিতে হবে অর্থ উপদেষ্টাকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির চাপ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে শ্লথ গতি সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরের জন্য আরেকটি বড় বাজেটের দিকে হাঁটছেন অর্থ উপদেষ্টা। অর্থাৎ তার বাজেটটি হবে সম্প্রসারণমূলক। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র খবরের কাগজকে বলেছে, সরকারের আয় কমে গেলও ব্যয়ের চাপ আছে। গত কয়েক বছরে সুদ পরিশোধ ও ভর্তুকিতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আগামী অর্থবছরেও এই দুই খাতে ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বড় বাজেট করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করে বাজেট করা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রস্তাবিত বড় বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে মাঝারি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ও মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এই বাজেট কমিয়ে সংশোধন হবে, যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারের বড় বাজেট দেওয়ার সক্ষমতা নেই। কারণ অর্থায়নে দুর্বলতা রয়েছে। তাদের মতে, বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া উচিত। তারা আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। তাদের কথা বিবেচনা করে আগামী বাজেটে সামাজিক খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এটি ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের যে বৈঠক হয়, সেখানে চলতি অর্থবছরের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় আছে।
বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এরই মধ্যে পূর্ভাবাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে না। যেমন: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত ২২ অক্টোবর পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এই অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফের স্টাফ মিশন বাংলাদেশে সফর শেষে এক বিবৃতিতে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। জানা গেছে, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে মূল্যস্ফীতির হার ও সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমান অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৯ শতাংশের নিচে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও পরও কমছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে দেশে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে জিনিসপত্রের দামে। যে কারণে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। গত ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হতে পারে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এডিপি ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এটি সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া হবে। এসব প্রকল্প চিহ্নিত করতে কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, রাজস্ব বাজেট ছাঁটাইয়ের সুযোগ কম, তাই বেশির ভাগ কাটছাঁট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে হবে। তাদের মতে, বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সাধারণত প্রতিবছর তাদের বাজেট বরাদ্দের বড় অংশ ব্যয় করতে পারে না। কাজেই বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ নেই।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে। এ ছাড়া অগ্রাধিকার প্রকল্প ও আগামী অর্থবছরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, এমন প্রকল্পে আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে। বৈঠকের একটি সূত্র বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ না হলে এবং বিদেশি তহবিল নিশ্চিত না হলে নতুন কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ না করার নির্দেশ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে সরকারের সুদ পরিশোধ ও ভর্তুকির জন্য ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং আগামী অর্থবছরে এই দুই খাতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে ভতুর্কিতে বরাদ্দ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ বর্তমানের চেয়ে কম পক্ষে ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে চলতি বাজেটে। তাদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাজেটে মহার্ঘ্য ভাতার জন্য বাড়তি বরাদ্দ থাকবে। ফলে বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এত বড় বাজেট কতটা যুক্তিসংগত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে, অর্থনীতির বাস্তবতাটা এখন কঠিন। তার মধ্যেও বাজেট করতে হবে। সবাই দেখতে চাইবে অন্তর্বর্তী সরকার পুরোনো চর্চা থেকে বেরিয়ে নতুনত্ব কী আনতে পারে। গত ১৫ বছর ধরে বাজেট ঘোষণার পর একটা কথা উচ্চারিত হয়ে আসছে- বাজেট উচ্চাভিলাষী। বাস্তবতার সঙ্গে বাজেটের লক্ষ্যগুলোর মিল থাকে না। অবাস্তব কিছু লক্ষ্যের ভিত্তিতে বড় আকারের বাজেট দিয়ে বাহাবা কুড়ানোর প্রচেষ্টা থাকে। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা পরিষ্কার বলতে পারি, বড় আকারের বাজেট দিলেও পুরোপুরি বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। কারণ অর্থায়ন মানে রাজস্বের অবস্থা দুর্বল। আদায় না বাড়ালে সংশোধিত বাজেটও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। চলতি অর্থবছর প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রকৃত খরচ হবে ৬ লাখ কোটি টাকা। কাজেই বাজেটের আকার বড় করে কোনো লাভ নেই। আমি মনে করি, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য ছোট আকারের বাজেট দরকার। বড় বাজেট হলে ঘাটতি বেশি হবে। আর ঘাটতি বেশি মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়াবে। আমার মতে, ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া উচিত। এর চেয়ে বেশি করা ঠিক হবে না। আমাদের বাস্তবায়নের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের যে আকার শোনা যাচ্ছে, তা যদি করা হয়, তাহলে আগের চেয়ে নতুনত্ব বলে কিছু থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘কঠিন সময়ে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। যেমন: অর্থায়ন, মূল্যস্ফীতি, বিদেশি ঋণ- এসব বিষয় বিবেচনা করে বাজেট তৈরি করতে হবে। বর্তমানে নিম্ন ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ কষ্টে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেট বেশি বরাদ্দ দেওয়া। কঠিন সময় মোকাবিলার জন্য সাধারণ মানুষের যা প্রয়োজন সেসব খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সম্ভাব্য বাজেটের আকার চলতি বাজেট অপেক্ষায় খুব বেশি বড় বলা যায় কি- প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, ‘চলতি বাজেটের সঙ্গে তুলনা করাটা একটা কাল্পনিক বিষয়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বর্তমান বাজেট কখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।’ তা হলে বড় বাজেটের প্রয়োজনীয়তা কেন? তার মতে, ‘আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার অবাস্তব। বাস্তবতার সঙ্গে সামাঞ্জ্যপূর্ণ নয়।’