খবরযোগ ডেস্ক: পুঁজিবাজার থেকে ২০২৪ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে চারটি প্রতিষ্ঠান এবং কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে দুটি কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া দুটি ব্যাংক বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করেছে। ফলে ২০২৪ সালের পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দিয়েছে।
এর আগের বছরে ২০২৩ সালে আইপিওর মাধ্যমে তিনটি, কিউআইওর মাধ্যমে তিনটি, মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে একটি ও চারটি বন্ড ইস্যু করে মোট ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছিল। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে ৪৬৭ কোটি টাকার কম মূলধন সংগ্রহ করেছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
কয়েক দিন পরই আসছে নতুন বছর ২০২৫। ২০২৪ সালের পুঁজিবাজার কেমন গেছে সেই হিসাব কষতেই বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। ২০২৪ সালের পুরো বছরে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছে ২৩৩ দিন। তবে ২০২৩ সালের মতো ২০২৪ সালের রাজনীতির মাঠ আর পুঁজিবাজারের ধারাবাহিকতা এক রকম ছিল না।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে থেকে জুলাই পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন চলমান থাকলেও আগস্ট থেকে চলতি বছরের সব কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
জুলাইতে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সহস্র প্রাণ হারানোর পর দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই দেশের জন্য গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে আসে নেতৃত্বের বদল। ২০২৪ সালের মে মাসে দ্বিতীয়বারের মতো আরও চার বছরের জন্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব আসা অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম মাত্র তিন মাসের ব্যবধানেই পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বর্তমানে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ২০২৪ সালের সালতামামিতে দেখা গেছে শিবলী কমিশন পুঁজিবাজার পরিচালনা করেছে ১৩৬ কর্মদিবস। আর রাশেদ মাকসুদের কমিশনের পরিচালনায় ছিল ৯৭ দিন।
তালিকাভুক্তি- বুক বিল্ডিং
সাবেক শিবলী কমিশনের আওতায় মূলত পুঁজিবাজার থেকে ৫টি কোম্পানির আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৬৬১ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। আগস্টের পর নতুন করে কোনো কোম্পানিকে আইপিও প্রক্রিয়ার পুঁজিবাজারে থেকে টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তবে রাশেদ মাকসুদের কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে ১৫টি কমিশন সভায় পুঁজিবাজারের কারসাজিকারীদের খুঁজে জরিমানা করেছে ২৮০ কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজার থেকে ওষুধ খাতের কোম্পানি টেকনো ড্রাগস লিমিটেড বুকবিল্ডিং পদ্ধতির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। সংগৃহীত অর্থে কোম্পানিটি নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিএমআরই (নরসিংদী কারখানা), ভবন নির্মাণ (গাজীপুর কারখানা), আংশিক ঋণ পরিশোধ ও ইস্যু ব্যবস্থাপনা খরচ খাতে ব্যয় করবে।
পুঁজিবাজার থেকে একই পন্থায় ৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। গত মার্চে লেনদেন শুরু করা এই কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণ, উৎপাদন ভবন নির্মাণ, ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যবহার করবে।
তবে রাশেদ মাকসুদের কমিশন গত নভেম্বরে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার এবং বিগত ৬ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন শুরুর আগে আরও একটি কোম্পানির বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা ছিল পুরো বছরের মধ্যে পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা উত্তোলন। বেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডকে শিবলী কমিশন এই সুযোগ দিলেও রাশেদ মাকসুদের কমিশন গত সেপ্টেম্বরে বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের আইপিও অনুমোদন ও ইস্যুসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
তালিকাভুক্তি- স্থির মূল পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে ২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে একটি ব্যাংক ও একটি বিমা কোম্পানি।
এনআরবি ব্যাংক সরকারি সিকিউরিটিজ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের জন্য ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ১০ কোটি শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এ ছাড়া সিকদার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের আইপিওর মাধ্যমে ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।
তবে সম্প্রতি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওর মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলন করতে চাওয়া আবাসন খাতের কোম্পানি বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের আবেদন বাতিল করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)।
ছিল বড় বড় জরিমানা
শিবলী কমিশনের সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন আবুল খায়ের। কিন্তু বর্তমান কমিশন এসেই তাকে একের পর এক করছে জরিমানা। পুঁজিবাজারে কারসাজির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হিরুসহ জরিমানার ফাঁদে পড়েছে তার পুরো পরিবার।
তালিকায় আছেন তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বোন কণিকা আফরোজ, ভাই সাজেদ মাতবর ও মোহাম্মদ বাসার, শ্যালক কাজী ফুয়াদ হাসান ও কাজী ফরিদ হাসান, নিকটাত্মীয় আলেয়া বেগম এবং হিরুর সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান মোনাক হোল্ডিংস।
এরা সবাই ২০২১ সালে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নতুন কমিশন গত ৫ ডিসেম্বর সবাইকে একসঙ্গে ১৩৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জরিমানা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয় হিরুর বাবাকে, ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। হিরুকে জরিমানা করা হয় ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার হিসেবে সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করতে পারলেও পুঁজিবাজারের খেলায় মারাত্মকভাবে হেরে গেছেন সাকিব আল হাসান। কমিশন পুনর্গঠনের পর প্রথম সভায় সাকিবকে শুভেচ্ছাদূত বা অ্যাম্বাসেডর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আগের কমিশন তাকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচির শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করেছিল। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকায় সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
বিএসইসির সর্বশেষ কমিশন সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠান- বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও শাইনপুকুর সিরামিকসের গত পাঁচ বছরের আর্থিক কর্মকাণ্ড বিশেষ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এখন জেলে আছেন। তিনি দীর্ঘদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।
বিনিয়োগকারীদের আসা-যাওয়া
২০২৪ সালের শুরুটা স্বাভাবিক থাকলেও আগস্ট মাসের পর থেকে পটপরিবর্তনের কারণে বদলে যেতে থাকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের হিসাব-নিকাশ। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারে পুরুষ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৫৩ জন, আর নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৭ জন। ফলে বাজারে মোট বিনিয়োগকারী ছিল ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪০টি। এর মধ্যে প্রবাসী বিনিয়োগকারী ছিল ৫৫ হাজার ২৮৫ জন।
বছরের শেষ প্রান্তে এসে সিডিবিএলের তথ্য বলছে, ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে পুরুষ বিনিয়োগকারী আছেন ১২ লাখ ৬১ হাজার ৬৩ জন এবং নারী বিনিয়োগকারী আছেন ৪ লাখ ৩ হাজার ৭৩৪ জন। মোট বিনিয়োগকারী ছিল ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯৭ জন। বিদেশি বিনিয়োগকারী আছেন ৪৬ হাজার ৭০০ জন।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আসা-যাওয়া হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ১ বছরে ৯১ হাজার ৬১৩ জন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে চলে গেছেন। এর মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারী কমেছে ৬৫ হাজার ৮৯০ জন আর নারী বিনিয়োগকারী কমেছে ২৫ হাজার ৭৫৩ জন। এই এক বছরে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারী কমেছে ৮ হাজার ৫৮৫ জন।
তবে ৫ আগস্টের পর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। স্থিতিশীল অর্থনীতি ও কারসাজিকারীদের ধারাবাহিকভাবে জরিমানা করায় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সুরক্ষা বিবেচনায় নতুন যুক্ত হয়েছেন পুঁজিবাজারে।
দেখা গেছে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৭৭৯ জন। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারী ৩৮৩ জন কমেছে।
সূচক
২০২৪ সালের প্রথম লেনদেনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক লেনদেন শেষ দাঁড়িয়েছিল ৬২৪২ দশমিক ৮৭ পয়েন্টে। ২৬ ডিসেম্বরের লেনদেন শেষে এই সূচক দাঁড়িয়েছে ৫১৮৪ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট। এই এক বছরে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১০৫৮ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট। এই সময়ে পুঁজিবাজারে সাত কর্মদিবসে ১০০ পয়েন্টের বেশি সূচকের উত্থান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সূচকের উত্থান হয়েছিল ৮ আগস্ট ৩০৬ পয়েন্ট। শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানিগুলো নিয়ে গঠিত ডিএসইএস সূচক ২০২৪ সালের প্রথম কর্মদিবসের লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছিল ১৩৬১ দশমিক ২৩ পয়েন্টে এবং গত ২৬ ডিসেম্বরের লেনদেন শেষ দাঁড়িয়েছে ১১৬৬ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে।
লেনদেন
২০২৪ সালের ২৩৩ দিনের পুঁজিবাজারে মোট লেনদেন হয়েছে ১৪৭৭৬৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের শুরু দিনে লেনদেন হয়েছিল ৪৪৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এবং সবচেয়ে কম লেনদেন হয়েছে ২৪ জুলাই ১৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
বাজার মূলধন
২০২৪ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারে বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৭৮০৮২৩ কোটি এবং ২৬ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬৬০১৬০ কোটি টাকা।