সিনিয়র এএসপি পলাশ সাহার আত্মহত্যার পর থেকেই স্ত্রী সুস্মিতা সাহাকে নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। স্ত্রীর জন্যই আত্মহত্যা করেছেন পলাশ এমনটাই ঘুরেফিরে আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে নিহত পলাশের স্ত্রী সুস্মিতার পরিবারে সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ভিন্ন কথা।
পলাশের স্ত্রী সুস্মিতার বাবা ভরত সাহা বলেন, ‘আমি, আমার বউ কেউই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারিনি মেয়ের শাশুড়ির কারণে। শাশুড়ি যে এতো দজ্জাল তা আমাদের জানা ছিল না। যেদিন মারা যায় সেদিন সকালেও ফোন দিয়েছিল জামাই পলাশ। বলেছিল সুস্মিতাকে নিয়ে যান ওই কিছুদিন আপনাদের ওখানে থেকে আসুক।’
এভাবেই কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদেই যাচ্ছিলেন ভরত সাহা।
ফরিদপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা তিনি। তার একমাত্র মেয়ে সুস্মিতা সাহার বয়স ২০। বছর দুই আগে বিয়ে হয় পলাশের সঙ্গে।
সুস্মিতার বাবা বলেন, ‘মেয়েকে বিয়ে করিয়ে নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। আমি বিয়ে দেব না, আমার কোনো অর্থকড়ি নেই। অনেক সমস্যার মধ্যেও আমি মেয়েকে বিয়ে দিই। এই ছেলে (পলাশ) আমার মেয়েকে ছাড়া বিয়ে করবে না। আমি রত্ন পেয়েছিলাম। এই জামাই (পলাশ) আমার রত্ন ছিল। তার পরও আমি মেয়ে বিয়ে দিতাম না, আমার মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি। সাহার (সম্প্রদায়) মধ্যে ছেলে পাবো না তাই চিন্তা করলাম একদিন না একদিন মেয়ে বিয়ে দিতে হবে, এ কারনেই আমি বিয়ে দিলাম। বিয়ের পর থেকে একটি দিনের জন্যও আমি, আমার বউ, আমার একমাত্র ছেলে ওদের (পালাশের) বাড়িতে যেতে পারিনি এই মহিলার (সুস্মিতার শাশুড়ি) জন্য। শাশুড়ি যে এতো দজ্জাল আমাদের জানা ছিলো না, কেউ আমাকে বলে নাই। বিয়ের পর বাড়িতে যেতে দেরি হওয়ায় আর্শিবাদ করবেই না। বলে, বউ পেয়ে পাগল হয়ে গেছিস।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় থাকাকালীনও আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলে একটি দিনের জন্যও যেতে পারিনি। এই শাশুড়ির কারনে। আমার জামাই (পালাশ) ফোনে করে বলে, আমার মা একটু অন্যরকম, এখন পর্যন্ত আপনাদের আনতে পারিনি। আপনি মনে কিছু করেন না। এজন্য আমি ক্ষমা চাই।’
ভরত সাহা বলেন, ‘যেদিন মারা যায়, সেদিন সকালেও ফোন দিয়েছিল জামাই পলাশ। বলেছিল সুস্মিতাকে নিয়ে যান ওই কিছুদিন আপনাদের ওখানে থেকে আসুক। আমি অফিসে যাই। আর অফিসে গিয়েই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আগের দিন ঝগড়াঝাটি করেছে। আমার মেয়েকে মেরেছে। মাঝে মধ্যেই আমার মেয়েকে মারে। না খাইয়ে রাখে এই শাশুড়ি। আমার জামাই মেয়ের ঘরে যেতে চাইলে যেতে দিতো না। বলতো আগে আমার ঘরে থাকবি। আর পরে বউয়ের কাছে যাবি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুস্মিতার শাশুড়ির অহংকার হলো, আমরা গরীব, আমরা তেমন কিছু দিতে পরিনি। বিভিন্ন সময় আমার মেয়েকে বলেছিল আমরা ১০০ ভরি স্বর্ণ দেব, বাড়ি দেব, গাড়ি দেবে বলে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করত। আমার মেয়ে অতিষ্ট হয়ে অত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম মা’রে তুই যদি কিছু করছিস আমি মরে যাব। মারা যাওবার আগের রাতে পলাশের মা কাকে যেন বলে, পালাশকে আমার মেয়ে মারধর করেছে। তখন আমার মেয়ে পলাশকে বলে শোন, কি বলে তোমার মা? তখন আমাকে বলে সুস্মিতা আমার গায়ে কোনো হাত দেয়নি।’
সুস্মিতার কাকীমা সাধনা জানান, মারা যাওয়ার ৩-৪ দিন আগে পলাশ সুস্মিতাকে অনেক কথা বলে। সুস্মিতার এক আত্মীয় ননদের কাছে সুস্মিতা বলে ‘পলাশ বলেছে আমার মা-তো তোমাকে দেখতে পারে না, আমি যদি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে সব খরচ খরচা দিই তুমি তোমার বাবার বাড়িতেই থাকো। এটা নিয়ে ও (সুস্মিতা) অনেক কান্নাকাটি করেছে। বাচ্চা নেওয়ার বিষয়ে পলাশ অফিসের এক কলিগের সঙ্গেও কথা বলেছিল। পলাশ বলেছিল আমি অনেক বাচ্চা পছন্দ করি, কিন্তু মায়ের জন্য বাচ্চা নিতে পারছি না। আমার মা চায় আমি যেন আমার বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। সে (পলাশ) নিজেই বলেছিলো তুমি (সুস্মিতা) এখানে টিকতে পারবে না, তোমার এখানে টেকা সম্ভব না, তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি তোমার সব খরচ দেব।’
তিনি আরও বলেন, পালাশ যাওয়ার সময় সুস্মিতাকে টাটা দিয়েছিল, তার মা (পলাশের মা) দেখার পর থেকেই কেন টাটা দিয়েছিল তা নিয়ে অশান্তি হয়। সুস্মিতার রান্না করা ডালের প্রশংসা করায় ডালের গামলা ফেলে দিয়েছিল সুস্মিতা শাশুড়ি।
গত বুধবার (৭ মে) দুপুর সাড়ে ১২টায় র্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্প থেকে সিনিয়র এএসপি পলাশ সাহার গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের পাশ থেকে একটি চিরকুট পাওয়া যায়।
ওই চিরকুটে উল্লেখ করা হয়, ‘আমার মৃত্যুর জনা মা এবং বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী। কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না। বউ যেন সব স্বর্ণ নিয়ে যায় এবং ভালো থাকে। মায়ের দায়িত্ব দুই ভাইয়ের ওপর। তারা যেন মাকে ভালো রাখে। স্বর্ণ বাদে যা আছে তা মায়ের জন্য। দিদি যেন কো-অর্ডিনেট করে।’
পরে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে র্যাবের পাহারায় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সিনিয়র এএসপি পলাশ সাহার মরদেহ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তাড়াশী গ্রামে। দুপুরে উপজেলার পারকোনা শ্মাশানে তার শেষকৃত্য হয়।