ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে খাদ্যভান্ডার খ্যাত উপজেলা আখাউড়া। দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে দীর্ঘদিন থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে এ উপজেলা।
এ মৌসুমে খাদ্যের চাহিদা পূরণে কৃষকরা ইরি-বোরো ধান আবাদ করেন। ফলন বৃদ্ধিতে বেশিরভাগ কৃষক ক্ষেতের রোগ-বালাই পোকার আক্রমণ ও আগাছা দমনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মাস্ক বা গ্লাভস পরার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না তারা। সচেতনতার অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জমিতে চাষাবাদ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত ধান, গম-সবজিসহ অন্যান্য ফসলের রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা খেতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক (বিষ) দিয়ে থাকেন। সঠিক পরামর্শের অভাবে নিরাপদ পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহার না করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এখানকার কৃষকরা। ফলে শ্বাসকষ্ট, চুলকানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কৃষকেরা। এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, নিরাপদ পদ্ধতি ছাড়া কীটনাশক ব্যবহার চরম বিপদজনক এবং এতে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৮টার আগে এবং বিকেল ৪টার পর কীটনাশক ছিটানোর উপযোগী সময়। আর সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হলে বিশেষ পোশাক পরিধান করার নিয়ম রয়েছে।
স্থানীয় একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, জমিতে কীটনাশক ছিটানো আর সার ব্যবহারের বিধি নিয়ে তারা কখনো কৃষি দফতরের সহযোগিতা পায়নি। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে মাঠে তারা কাজ করছেন। তারা জানায় কীটনাশক ছিটানোর সময় প্রায়ই খুবই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে মাথা ঘোরে বা ব্যথা করছে। তবে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি।
অন্যদিকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। ফলন বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সাথে এসব বিষয়সহ নানা বিষয় নিয়ে পরামর্শ করা হচ্ছে। কৃষকদের বারবার সচেতন করলেও কাজে আসছে না।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকেরা প্রখর রোদে ধান ক্ষেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কারো নাকে-মুখে মাস্ক বা কাপড় নেই। হাতে নেই কোনো হাতমোজা বা গ্লাভস। গায়ে আছে সাধারণ টি-শার্ট। কাঁধে ঝোলানো মেশিন থেকে বেরিয়ে আসছে কীটনাশকের ‘বিষ’। কেউ আবার আগাছানাশক মিশিয়ে হাতমোজা ছাড়াই হাত দিয়ে ছিটাচ্ছেন রাসায়নিক সার। কীটনাশকের প্যাকেট বা বোতলের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে বিষ লেখা থাকলেও তা নিয়ে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছেন না। নিয়মনীতি না মেনেই এলাকার কৃষকরা যে যার মতো জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। এভাবে করতে গিয়ে অনেক কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
উপজেলা দক্ষিণ ইউনিয়নের কৃষক মো. মহসিন মিয়া বলেন, জমিতে পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সব সময় আমরা কীটনাশক দিয়ে আসছি। তবে কীটনাশক জমিতে দেওয়ার সময় উদ্ভট গন্ধসহ্য করতে হয়। এছাড়াও ওষুধ প্রয়োগের পর অনেক সময় মাথা ঘোরাসহ নানা সমস্যা হয়। কিন্তু কিভাবে ওষুধ প্রয়োগ করলে কোনো সমস্যা হবে না, তা আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে কখন কেউ পরামর্শ দেয়নি। এভাবেই আমরা জমিতে বছরের পর বছর কীটনাশক প্রয়োগ করছি।
উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের কৃষক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, আমার নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ‘দীর্ঘ বছর ধরে জমি আবাদ করছি। চলতি মৌসুমে ৬ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের ধান আবাদ করা হয়। চারা লাগানোর কিছু দিন পর জমিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে জমিতে কীটনাশক দিয়েছি। কীটনাশক ছিটানোর সময় কোন প্রকার মাস্ক বা গ্লাভস রাখা হয় নি।
স্থানীয় একাধিক লোকজন জানায়, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জমিতে ছিটানো কীটনাশকের দুর্গন্ধে নিশ্বাস নেয়া যায় না। চলাচল করতে কষ্ট হয়। চোখ জ্বালাপোড়া করে।
এদিকে সচেতন মহল বলছেন, কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রচার করতে হবে মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করা শাক-সবজিসহ সব কৃষিপণ্য মানবদেহের জন্য জন্য ক্ষতিকর। ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তারা।
আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. লুৎফর রহমান বলেন, কীটনাশক (বিষ) ছিটানোর সময় নিরাপদ পোশাক ব্যবহার না করলে নাক ও মুখ দিয়ে বিষ শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে অনেক সময় শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও চর্মরোগসহ নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জমিতে কীটনাশক ছিটানোর ক্ষেত্রে নাক-মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ব্যবহার করলে এসব রোগ থেকে সুরক্ষা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে কৃষকের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া তাবাসসুম বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত কৃষকদের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে আসছি। তাছাড়া কৃষকদেরকে প্রতিনিয়ত আলোক ফাঁদ-এর মাধ্যমে চাষাবাদের পরামর্শ দিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়। তাই কীটনাশক ব্যবহার না করে অধিক ফসল ফলানোর জন্য জৈব পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ গার্ডিয়ান/MK