বিশ্ববাজারে সোনার দাম যেন ছুটছে রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে। কয়েক মাসের ধীর গতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখন যেন রকেটের গতিতে পৌঁছে গেছে এক নতুন উচ্চতায়। আর এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে মার্কিন ডলারের ক্রমাগত পতন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার (২১ এপ্রিল) স্পট মার্কেটে সোনার দাম প্রতি আউন্সে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪১৫ দশমিক ২৪ ডলারে। সেশনের শুরুতে এটি রেকর্ড ৩ হাজার ৪২৪ দশমিক ২৫ ডলারে পৌঁছায়। অন্যদিকে, ফিউচার মার্কেটে সোনার দাম প্রতি আউন্সে ৩ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৪২৬ দশমিক ৩০ ডলারে লেনদেন হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতো দ্রুত এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে ডলারের মানহানি। সোনার দাম সাধারণত ডলারের বিপরীতে চলে—ডলারের মান কমলে সোনার দাম বাড়ে।
বর্তমানে ডলারের মান গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা ডলারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। এই দুর্বলতা সরাসরি সোনার চাহিদা এবং দামে বড় প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিকে করে তুলেছে অনিশ্চয়তাপূর্ণ। ফলে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে সোনাই ঝুঁকছে বিনিয়োগকারীরা।
এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের প্রতি অসন্তোষ এবং তার অপসারণের সম্ভাবনা নিয়েও বাজারে গুঞ্জন রয়েছে, যা আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে।
শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরাই নন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যেও সোনা কেনার প্রবণতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সোনা কাউন্সিল জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যাপকভাবে সোনা কিনেছে, আর ২০২৫ সালে সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমাগত সোনা কিনছে, ডলার নির্ভরতা কমিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তুলতেই এই পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা।
বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, যদি বর্তমান গতিতে বাজার চলতে থাকে, তবে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনার দাম ৩ হাজার ৭০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, সোনা এখন কেবল নিরাপদ নয়, বরং লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
ইউবিএস বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাউনোভো বলেন, “রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের ওপর উদ্বেগ ও শেয়ারবাজারের দুর্বলতা বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ সম্পদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সোনার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রযোজ্য।”
আইজি মার্কেটসের কৌশল বিশ্লেষক ইয়াপ জুন রং বলেন, “ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর চাহিদা সোনার দামে ঊর্ধ্বগতি বজায় রাখবে। স্বল্পমেয়াদে হয়তো কিছুটা চাপ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে সোনা শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে।”
বাংলাদেশে প্রভাব কেমন?
এ প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। দেশের বাজারে সোমবার (২১ এপ্রিল) ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরিতে ৪ হাজার ৭১৩ টাকা বাড়িয়ে রেকর্ড ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)।
এছাড়া ২১ ক্যারেট সোনার দাম ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাজুস, যার মধ্যে ১৮ বারই দাম বেড়েছে।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা, ট্রাম্পের শুল্কনীতি, ফেডের সুদহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা—সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়ছে। ডলারের পতন এবং সেই সুযোগে সোনার উল্লম্ফন একে অন্যকে প্রভাবিত করছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিগগিরই ৩ হাজার ৫০০ ডলার প্রতি আউন্স ছাড়িয়ে যেতে পারে সোনার দাম।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু সোনা তাৎক্ষণিক লভ্যাংশ দেয় না, তাই এটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত। তবে সময় বুঝে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করাই ভালো।
মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগের বিকল্প সংকোচনের এই সময়টাতে আবারও প্রমাণিত হচ্ছে—সোনা তার ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা এখনও হারায়নি। বরং ডলারের দুর্বলতা সেটিকে আরও শক্ত ভিত দিয়েছে বিশ্ববাজারে।