খবরযোগ ডেস্ক :
দাউদাউ করে জ্বলছিল থানা ভবন। যে যেমন পারছিল থানার আসবাব-সরঞ্জাম, এমনকি অস্ত্র-গোলাবারুদও নিয়ে যাচ্ছিল। প্রাণভয়ে পুলিশ সদস্যরা ছুটে পালাচ্ছিলেন। কেউ কেউ আবার বাধা দিতে গিয়ে বা বিক্ষোভকারীদের সামনে পড়ে মারপিটসহ করুণভাবে হত্যার শিকার হন। ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় বের হলেই পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গালিগালাজ- ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে ভর্ৎসনা করা হচ্ছিল। এভাবেই গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে সময় পার করতে হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। স্বাধীনতার পর পুলিশকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আর কখনোই হতে হয়নি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তথা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। ওই সময় পুলিশ সদস্যরাই দেশমাতৃকার জন্য প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সেই এক রাতেই রাজারবাগে শহিদ হন অন্তত ২১০ সদস্য। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় গত ৫৩ বছরে পুলিশের জন্য এত বড় বিপর্যয় আর কখনো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা মুঠোফোনে বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পুলিশ বাহিনীতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। এখানে পুলিশ বাহিনী জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বা দাঁড় করানো হয়েছিল। এর জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাই বেশি দায়ী। তারা অনেকেই আইন মোতাবেক কাজ করেননি। জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে কারণে জনগণের রোষানলে পড়তে হয় পুলিশকে।’
নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘পুলিশকে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু অবশ্যই বলপ্রয়োগ হতে হবে আইনসংগতভাবে। জনগণের অধিকার ও মনের ভাষা বুঝতে হবে।’
পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৪ হাজার বাঙালি সদস্য সরাসরি স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অন্তত ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি শহিদ হন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- মুক্তিযুদ্ধের সেই পুলিশ আর ‘চব্বিশের’ এই পুলিশের ভূমিকা কীভাবে এত বিপরীতমুখী হলো! এই বাহিনীর এমন গৌরবময় ইতিহাস, যেখানে তারা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তারা কেন ২০২৪ সালে এসে এতটা জনরোষের শিকার হলেন?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পুলিশের গৌরবময় অবদান আর ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে পুলিশের ভূমিকা দুটিই সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি ছিল দেশের স্বাধীনতা ও সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য, আর অন্যটি (জুলাই-আগস্ট) দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়ার জন্য।
জুলাই-আগস্টে মহাবিপর্যয়ে পড়ে পুলিশ
গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন চাঙা হয়ে ওঠে। শাহবাগ মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংশ্লিষ্টরা। পর্যায়ক্রমে আন্দোলনের সময় ও তীব্রতা বাড়তে থাকলে পুলিশও বলপ্রয়োগ বাড়াতে থাকে।
একপর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে বক্তব্য দিলে জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কোটা আন্দোলন রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। তখন ডিবি পুলিশ আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায়। পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন দমাতে পুলিশ আগ্রাসী ভূমিকা শুরু করে। পুলিশ বিক্ষোভে গুলি চালায়, লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ব্যবহার করতে থাকে। পাল্টা জবাবে কোথাও কোথাও পুলিশও হামলার ও হত্যার শিকার হতে থাকে। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ানক রূপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে রাজধানী ঢাকা ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তাল-অগ্নিগর্ভ। আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং সাধারণ মানুষও যোগ দেওয়ায় আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়। ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই লাশের সারি বাড়তে থাকে।
এরপর ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় কারফিউ জারি করে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থেমে যায়নি, দু-চার দিন বিক্ষোভের মাত্রা কম দেখা গেলেও আগস্ট থেকে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা কঠোরভাবে বল প্রয়োগ করতে থাকে। এতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
একপর্যায়ে ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সেদিনই সবচেয়ে বেশি পুলিশ আক্রান্ত হয়, সারা দেশে বহু থানায় হামলা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে পুলিশের অধিকাংশ সদস্য থানা বা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে যান। তারা পোশাক পাল্টে সাধারণ পোশাকে আত্মগোপনে চলে যান। পরে বেশ কয়েক দিন ‘পুলিশবিহীন’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। মানসিকভাবেও পুলিশ ভেঙে পড়ে। অনেকে চাকরি ছেড়ে দেন, অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান।
এ ঘটনার পর ঘুরে দাঁড়ালেও দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য শেষ পর্যন্ত চাকরিতে আর যোগ দেননি বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়। সব মিলিয়ে পুলিশে নেমে আসে চরম এক বিপর্যয়।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা কামরুল আহসান জানান, গত জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকালে পুলিশের ৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৬৬ জন, যাদের মধ্যে ৪৮২ সদস্যের অবস্থা গুরুতর।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেসে’ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকালে ডিএমপির বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ অস্ত্র লুট হয়েছে। এখন পর্যন্ত (৯ ডিসেম্বর) প্রায় ১ হাজার ২০০ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। বাকিগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত ও ৩১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি এ তথ্য জানিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘সরকার পতনের পর পুলিশে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। তবে পুলিশকে আবারও ঢেলে সাজানো হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে শতভাগ পেশাদারত্ব নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি।’
পুলিশের এমন বিপর্যয়ে দায়ী কারা
পুলিশ বাহিনী কেবল জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নয়, বরং আওয়ামী শাসনামলে সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের হয়ে বেআইনিভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর প্রতি জুলুম-অত্যাচার করা, ঘুষ-দুর্নীতি-ফৌজদারি অপরাধে জড়ানো, ক্ষমতার দাপট বা স্বেচ্ছাচারিতা, কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট, চেইন অব কমান্ড না থাকাসহ নানা কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর গুলি চালানো ও দমননীতি প্রয়োগের ফলে বাহিনীর বিরুদ্ধে জনবিস্ফোরণ ঘটে। এমন পরিস্থিতির জন্য পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা বা সদস্যকে দায়ী করা হয়ে থাকে। যাদের অপকর্মের জন্যই গোটা পুলিশ বাহিনীর বিপর্যয়ের শিকার হয় বলে মনে করেন বাহিনীর স্বয়ং সদস্যরাও। এর মধ্যে বেশি আলোচিত নামগুলো হচ্ছে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার,সনজিত কুমার সরকার সহ আরও কয়েকজন।
অথচ, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক প্রশংসিত কর্মকাণ্ড ইতোপূর্বে সাধারণ মানুষ দেখেছে। যেমন, কোভিড-১৯ তথা করোনাকালে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির কাছে যখন নিকট স্বজনরাও যেতে ভয় পেতেন তখন তারা ঝুঁকি নিয়ে লাশের দাফন বা সৎকারের কাজ করেছেন। সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষ যখন অনেকটা গৃহবন্দি, তখন পুলিশ সদস্যরা অনাহারি বা জরুরি প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের বাসাবাড়িতে খাদ্যপণ্য ও ওষুধ সরবরাহ করেছে। এজাতীয় আরও অনেক মানবিক কাজ আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যুতে পুলিশ বাহিনী ব্যবহৃত হয়ে তার গৌরবময় অর্জন-অবদান অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা।
বদলি ৫০ হাজার
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের নানা পদে রদবদল হয়েছে। গত চার মাসে বদলি বা পদায়নের ঘটনাগুলো রেকর্ড হয়েছে। এই সময়ে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যকে (কর্মকর্তাসহ) কর্মস্থল পরিবর্তন বা বদলি করা হয়। পুলিশে বর্তমানে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪ জন সদস্য কর্মরত বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশে চলছে সংস্কার
জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়ায় স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ পুরো বাহিনী সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, পুলিশ যাতে মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেটির প্রস্তাবনা আনা হয়েছে সংস্কার প্রক্রিয়ায়। যেকোনো সময় এ সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা।