খবরযোগ ডেস্ক:
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ চব্বিশটি বিভাগ ন্যস্ত রয়েছে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদের কাছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ওই তিন জেলার প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। জেলা পরিষদে নিযুক্ত চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা চলে গেছেন আত্মগোপনে। কয়েকজন বাদে বাকিরা সবাই একাধিক মামলার আসামি হয়ে এখন ফেরারি। আবার কারও নামে রয়েছে ডজনেরও বেশি মামলা।
দেশের অন্য ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করে ইতোমধ্যে প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা পরিষদ এখনো বিলুপ্ত করা হয়নি। এখনো খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্য পদে বহাল রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। পরিষদ বিলুপ্ত না করে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ওই তিন জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকী বলেন, ‘পূর্বের পরিষদ এখনো বহাল আছে। শিগগির নতুন পরিষদ গঠনের মাধ্যমে বর্তমান পরিষদকে বিলুপ্ত করা হবে।’নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কার্যালয়ে না আসায় পরিষদের প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। তাই বিশেষ বিবেচনায় মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।’
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নতুন করে সাবেক সরকারের দোসরদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের তালিকায় জাতীয় পার্টির প্রথম সারির নেতা, পাহাড়ের প্রভাবশালী আঞ্চলিক সংগঠনের সক্রিয় নেতা-কর্মী ও সহযোগীদের নাম এক্ষেত্রে চাউর হচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে বিস্তর সমালোচনা। সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও গোপন যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন হয় না ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৮৯ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদের ১৯, ২০ ও ২১নং আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেই বছরের ২৫ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিন বছর স্থায়িত্বের ওই পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিন যুগেও আর কোনো নির্বাচন হয়নি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পৃথক ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচনের দাবি তোলেন। পরে সরকারিভাবে শুরু হয় পৃথক ভোটার তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়া। সন্তু লারমার দাবির বিপক্ষে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলায় মাঝপথেই থেমে যায় ভোটার তালিকা প্রস্তুতের কার্যক্রম।
আইনগত জটিলতার মুখে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন করা সম্ভব না হওয়ায় সেই সময়ে ‘অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ’ গঠনের পদ্ধতি সন্নিবেশ করে আইন সংশোধন করা হয়। সেই সংশোধিত আইনে ১৬ (ক) এর উপধারা-২ অনুযায়ী সরকার একজন চেয়ারম্যান এবং চারজন সদস্যের সমন্বয়ে ‘অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ’ গঠনের বিধান এনে দলীয় বিবেচনায় মনোনীত আওয়ামী লীগ নেতাদের চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ হয়। পরে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে সাড়ে ৬ মাস অন্তর অন্তর মেয়াদ বাড়িয়ে পরিষদ পরিচালনা করা হয়। এক-এগারোর জরুরি সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনরায় দলীয় নেতা-কর্মীদের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে পুনর্বাসন করা শুরু করে। সেই ধারা অব্যাহত থাকে গত সাড়ে ১৫ বছর। সবশেষ ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর একজন চেয়ারম্যান ও চৌদ্দজন সদস্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদ গঠনের আইন পাস করা হয়। বর্তমানে এই কাঠামোতেই চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা পরিষদ। অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ পরিচালিত হওয়ায় ইতিপূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও এর কোনো জবাবদিহি নেই। আওয়ামী সরকারের এই সাড়ে ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার করা হয়নি, একই সঙ্গে এই তিনটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করা হয়েছে হরিলুটের কারখানায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাহাদাৎ ফরাজী সাকিব বলেন, ‘ফের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফ্যাসিস্টদের কাউকেই যেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে আমরা আন্দোলনে নামব।’
সাবেক সংসদ সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাহাড়ের সাধারণ মানুষ এবং মেধাবীদের কোনো কল্যাণে আসেনি। কল্যাণ যা হয়েছে তা মন্ত্রী, এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের হয়েছে। এত বছর তিন পাবর্ত্য জেলা পরিষদ মূলত আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। যে যার মতো হরিলুট করেছেন। বিশেষ করে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নেতারা।’
ওয়াদুদ ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসেও পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের ফের পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা চলছে। যদি এমন কিছু করা হয় তবে বিএনপিসহ এ অঞ্চলের মেধাবঞ্চিত এবং সাধারণ মানুষ এর যথাযথ জবাব দেবে।’
খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা নিজেদের লোকজনকে জেলা পরিষদে পুনর্বাসন করেছেন। বিগত সরকারের তিন মেয়াদে দুর্নীতির মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষমতার প্রভাবে জেলা পরিষদে যা ইচ্ছে তাই করেছে ক্ষমতাসীনরা। আইন সংশোধন করে নির্বাচিত পরিষদ গঠন করা না হলে জেলা পরিষদগুলো কখনোই জবাবদিহির আওতায় আসবে না।