মাসুম মিয়া :
বনে পশু-পাখি থাকবে, থাকবে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চলবে বাস্তুসংস্থান চক্র। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আধুনিকতা আর কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে। সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় বন থেকে আজ বিলুপ্ত প্রায় পশু-পাখি। যার প্রভাব পড়ছে বাস্তুসংস্থান চক্রে। এমন বাস্তবচিত্র লক্ষ্য করা যায় টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের বনাঞ্চলে। পরিবেশবিদদের মতে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন করা হলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে।
ঘাটাইলের পূর্বাঞ্চল স্থানীয়দের কাছে পরিচিত পাহাড়ী এলাকা হিসেবে। এ উপজেলার আয়তনের প্রায় একতৃতীংশ ভূমি ছোট বড় অসংখ্য টিলা দিয়ে গঠিত। টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বনাঞ্চল। যা ছিল গাছপালায় ঘেরা ঘন জঙ্গল। একটা সময় মাথা উচু করে এই বনে রাজত্ব করত শাল-গাজারি। সঙ্গে ছিল আমলকি, হরিতকি, বহেরা, অর্জুন, তিতিজাম, আনাইগোটা, খেঁজুর, বট, শিমুল, ছাগলনাদি, চুকাইগোটা, জয়নাগোটা, পিতরাজসহ নাম না জানা নানা বৃক্ষ। আর এ সকল বৃক্ষের সঙ্গে মিতালি ছিল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর প্রাণিদের। তিন যুগ আগেও বন্যপ্রাণির ছোটাছুটি আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ছিল এ অঞ্চল। কিন্তু সরকারিভাবে বনবিভাগের সামাজিক বনায়নের কার্যক্রম আঘাত হেনেছে প্রাকৃতিক এ বনভূমিতে।
বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১৩ প্রজাতির দেশীয় গাছ। বনে বিদেশী গাছের আগমনে খাদ্য ও বাসস্থান সংকটে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে পাখি। বনে সারাদিন ঘুরে দু’চারটা শেয়াল ছাড়া অন্য কোনো প্রাণির দেখা মেলা ভার। তবে বন কর্মকর্তার দাবী কিছু পাখি বাসা বাধে। আর শিয়াল, সজারু এবং বানরের দেখা পাওয়া যায় কিছু এলাকায়।
বনবিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ঘাটাইল উপজেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। ৯০ দশকে ‘সামাজিক বনায়ন’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করে বন বিভাগ। আর এই কর্মসূচির বলি হয় এখানকার প্রাকৃতিক বন। বর্তমানে সামাজিক বনায়নের দখলে প্রায় ১৫ হাজার একর বনভূমি। যার পুরোটাই একটা সময় ছিল প্রাকৃতিক বন।
স্থানীয়রা জানায় কর্মসূচি সফল করতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এক শ্রেণির মানুষ দিয়ে দিনে-রাতে কুঠারের আঘাত চালানো হয় বনে আপনজালা দেশীয় বৃক্ষের গায়ে। সন্ধানপুর ইউনিয়নের কুশারিয়া গ্রামের বয়জৈষ্ঠ্য মোহাম্মদ আলীর ভাষ্য, প্রাকৃতিক বনের অস্তিত্ব মেলে কাগজে-কলমে। সরজমিনে প্রায় পুরোটাই সামাজিক বনায়নের দখলে।
বনাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সৃজন করা সামাজিক বনায়নের বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশ জায়গায়ই দখল করে আছে বিদেশী বৃক্ষ। বৃক্ষের নাম আকাশমনি, মিনজিয়াম, ইউক্লিপটাস। দেওপাড়া মালেঙ্গা এলাকায় আকাশমনি গাছের বাগানের পাশ দিয়ে বিকেলবেলা গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছিলেন মধ্যবয়সি আদিবাসী নারী সীমা রানী। তার ভাষ্য, বিদেশী এই গাছের তেমন কোনো ডালপালা নেই। ফল নেই। বীজের স্বাদ তেতো। পাতা বিষাক্ত। পাতা এতোটাই বিষাক্ত যে ওইসব গাছের নিচে ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না।
বাগানের পাশেই টিলার ঢালুতে (স্থানীয় ভাষায় বলে বাইদ) আমনধানের জমিতে পরিচর্যা করছিলেন কৃষক আব্দুর রাজ্জাক। পরিচর্যা বলতে আকাশমনি গাছের ঝরাপাতা ক্ষেত থেকে তুলে দূরে ফেলছিলেন তিনি। গাছের পাতা পঁচে তো জৈবসার হবে, তাহলে ফেলে দিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নে তার উত্তর-এই গাছের পাতা ফসলি জমিতে পড়লে ফসল পুড়ে যায়। পাতা বিষাক্ত। পঁচে না। এদিকে সীমা রানী ও আব্দুর রাজ্জাকের কথার সত্যতা মেলে সৃজন করা বাগানের ভেতর প্রবেশের পর। গাছের নিচে যে স্থানে পাতা ঝরে পড়ে আছে সেইস্থানে ঘাস বা আগাছা জন্মায়নি। আধাঘণ্টা হাটার পরও চোখে পড়েনি কোনো পাখি উড়ার দৃশ্য। অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি গাছে পাখির বাসার। দেওপাড়া গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া জানান, পাখি ফসলি জমিতে আক্রমণ করা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে থাকে। কিন্তু এলাকায় পাখি কমে যাওয়ায় পোকা দমনে ক্ষতিকর কিটনাশকের উপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।
হারুন মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে সূর্য্য। সন্ধ্যা না নামতেই দূর থেকে ভেসে আসে শিয়ালের হাঁক। এ হাঁক-ডাক বনে নয়, লোকালয়ে। মাকড়াই গ্রামের বাদল খান বলেন, বনে খাদ্য সংকটে সন্ধ্যা হলেই গ্রামের দিকে পথ ধরে শিয়াল। হানা দেয় গৃহস্থের হাঁস-মুরগীর উপর। কখনো আবার ছাগল-ভেড়া ধরে টানাটানি শুরু করে। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারে শিয়াল। এলাকাবাসি জানায় শিয়ালের এই অত্যাচার আগে খুব একটা ছিলনা। তাদের আশঙ্কা খাদ্যাভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন থেকে বিলিন হবে অবশিষ্ট থাকা এ প্রাণিটি।
বন ভেদ করে চলে গেছে ঘাটাইল-সাগরদিঘী সড়ক। গত মাসে এই সড়ক ধরে যাওয়ার পথে শুকনি নামকস্থানে তীব্র দুর্গন্ধ অনুভূত হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পচন ধরা মৃত শিয়ালের দেহ থেকে। পথচারী বিল্লাল হোসেন বলেন, বনে কোনো প্রাণি মারা গেলে শিয়াল ছাড়া আর কোনো প্রাণি নেই মরদেহ খাওয়ার। শিয়ালের মাংস শিয়াল তো খায়না। আর কাক তো দূরের কথা কোনো পাখিই এই গাছে বাসা করে না।
পাহাড়ী মানুষের দাবী সামাজিক বনায়ন করার আগে বাঘ, মেছোবাঘ, বনশূকর, হাতি, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রাণি এবং প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যেত এই বনে। ‘টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)’ নামে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সরকার একটি প্রকল্প চালু করে। দেশের ২৮ টি জেলায় ৫ টি বনাঞ্চলে প্রকল্পটি বাস্তাবায়ন করছে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর। এতে সম্পৃক্ত ১৬৫ টি উপজেলার ৬০০ গ্রাম। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- নতুন করে ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বনায়ন ও বন্যপ্রাণির আবাস্থল ও চলাচল পথের উন্নয়ন, বিপন্ন বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার লাল তালিকাকরণ, কিছু স্থাপনা নির্মাণ, বনাঞ্চলের আশেপাশের বননির্ভর ৬০০ গ্রামের ৪০ হাজার পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি।
ঘাটাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখানে সুফল প্রকল্পটি চালু হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ছয়টি বিটের মধ্যে প্রাথমিকভাবে বটতলী এবং ধলাপাড়া বিটে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। লাগানো হয় এক লাখ বনজ, ফলদ ও ওষুধি গাছ। আর এসব গাছ লাগানো হয়েছে প্রাকৃতিক বনের ভেতর। শাল-গাজারি গাছের নিচে। এদিকে ‘সুফল’ নামে এই প্রকল্পের কার্যক্রম ভাবিয়ে তুলছে স্থানীয়দের। তাদের শঙ্কা, এই প্রকল্পই একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে প্রাকৃতিক বনে অবশিষ্ট থাকা শাল-গজারির জন্য। কুশারিয়া গ্রামের মনোয়ার হোসেন সোহেল বলেন, গজারি গাছের নিচে অন্য গাছের চারা রোপন করার সময় জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। ফলে বনে অবশিষ্ট থাকা পশু-পাখি বিদায় নিয়েছে। আর কাঠচোরদের কাছে আকর্ষণীয় গাছ হচ্ছে গজারি। প্রকল্পের রোপন করা চারা গাছগুলো একটু বড় হলেই একদিন নাই হয়ে যাবে বড় গজারি গাছ। তিনি আরও বলেন, মৌসুমে গজারি গাছে প্রচুর পরিমাণে ফুল ধরে ফল ও বীজ হয়। সেই বীজ অঙ্কুরিতও হয়। শুধু দৃশ্যমান কোনো গাছ দেখা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেফালি বেগম সমকালকে বলেন, আমি অবশ্যই সামাজিক বনায়নের বিপক্ষে। প্রাকৃতিক বন ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বনে পাখি এবং প্রাণি বাস করতে পারে না। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন করার ফলে বাসস্থান এবং খাদ্য সংকটে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় বৃক্ষ, পাখি এবং প্রাণিকূল। ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে বনের বাস্তুসংস্থান চক্র। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে একটি দেশে প্রাকৃতিক বনের কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো.আখতার হোসাইন খান বলেন, সামাজিক বনায়নের নামে আমাদের এমন কিছু করা উচিত না যা প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করবে। সামাজিক বনায়ন করতে হবে রাস্তার আশেপাশে। যেখানে জমি পতিত রয়ে গেছে সেখানে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের জলবায়ু ও মাটি নিয়ে যে সকল গাছ বেড়ে উঠে সে সকল গাছ আমরা ধ্বংস হতে দিতে চাই না।
কিছু প্রশ্ন ছুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, এই সমাজ কি কখনো চেয়েছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে আমাদের সামাজিক বন করে দাও? কোন আইনে কার পরামর্শে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন করা হল? জনগণ কি চেয়েছিল বন কেটে আমরা সামাজিক বনায়ন করি? তাহলে কি সরকারি আদেশে প্রাকৃতিক বন কাটা হয়েছে? বনটা কি আগে থেকেই ল্যাংটা ছিল? তাঁর দাবী এসব প্রশ্নের উত্তর আগে খুঁজে বের করতে হবে। প্রাকৃতিক এই বনে প্রায় একশ প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। ছিল বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণি। যা ছিল বনের সৌন্দর্য। সামাজিক বনায়ন করার ফলে প্রকৃতিকে বিবেচনা করা হয়নি। জীববৈচিত্রকে বিবেচনা করা হয়নি। বিবেচনা করা হয়েছে গাছগুলো বড় হলে কেটে সরকার নিবে কিছু আর লোকাল লোকজন নিবে কিছু। এভাবে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার ফলে আমাদের ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে গেছে।
বিদেশী বৃক্ষ আকাশমনি গাছের পাতা জমিতে পড়লে জমি অনুর্বর হয়ে যায়। ফসল নষ্ট হয়ে যায়। যে সকল মাইক্রোফ্লোরা মাটিকে উর্বর রাখে সেই ফ্লোরাগুলো কমে যাচ্ছে। মাটিতে জৈববস্তু যদি না পঁচে তবে সয়েল ফরমেশন হবে না। মাটির গঠন আগলা হয়ে যাবে। খাদ্য একস্তর থেকে আরেকস্তরে যায় সেটা ব্যহত হতে পারে। সবুজ উদ্ভিদ কমে গেলে খাদ্য কমে যাবে, খাদ্য কমে গেলে সবুজ উদ্ভিদের উপর নির্ভর যে প্রাণি তা টিকে থাকতে পারবে না। তাহলে এই অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় কি? এমন প্রশ্নে জনাব জসীম উদ্দীন বলেন, প্রথমত সামাজিক বনায়ন না থাকলেও সমস্যা নেই। মানুষ এখন আর বনের উপর নির্ভরশীল নয়। আকাশমনি গাছ যা লাগানো হয়েছে আর লাগানো যাবেনা। যদি সামাজিক বনায়ণ করতেই হয় তবে দেশীয় বৃক্ষ লাগাতে হবে। মেয়াদ শেষে একসাথে আর গাছ কাটা যাবেনা। প্রত্যেক বছর বনায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষকে সামাজিক বনায়নের কুফল বুঝাতে হবে। বুঝাতে হবে প্রাকৃতিক বনের সুফল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। সর্বোপরি আমরা যদি প্রাকৃতিক বনায়নে ফিরে না যেতে পারি তবে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি খরাসহ অনেক কিছু ঘটতে পারে। হঠাৎ করে বন্যা হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সবকিছু।
সামাজিক বনায়নে লাগানো বিদেশী গাছ যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তা স্বীকার করে ঘাটাইল বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান সমকালকে বলেন, এখন মিশ্র গাছের বাগান করা হচ্ছে। লাগানো হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির গামার, গর্জন, কদম, চাপালিসহ অন্যান্য বৃক্ষ। এরপরও সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের আগ্রহের কারণে বিদেশী গাছ লাগানো হয়। তার দাবী কিছু পাখি বাগানে বাস করে। শিয়ালের দেখা সব জায়গায়ই মেলে। ধলাপাড়া ও শালিয়াবহ এলাকায় সজারু এবং দেওপাড়া এলাকাতে বানরের দেখা পাওয়া যায়। তবে এখানে বন্যপ্রাণির অভয়াশ্রম নেই বলে তিনি জানান।