নজরুল ইসলাম : টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আমুয়াবাইদ গ্রামের প্রায় ২৫০ বছর বয়সী এই গাছটির নাম জানে না এলাকার মানুষ। নাম না জানার কারণে গাছটি ‘অচিন গাছ’ নামেই পরিচিত স্থানীয় মানুষের কাছে। গাছটি ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যেও রয়েছে নানা কৌতূহল, রয়েছে নানা কথা-উপকথা। কেউ বলে কোচার দেশের যাদুর মাধ্যমে চালান করা গাছ। আবার কেউ বলে জিন-ভূতের আস্তানা। তবে স্থানীয়রা কেউ কখনও জিন-ভূতের কোন দৃশ্য দেখেনি।
বাংলাদেশ পান্ট ট্যাক্সোনোমিস্ট সমিতি এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম গবেষণা করে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ২৫০ বছরের পুরোনো অপর একটি অচিন গাছের নাম দিয়েছে ‘কুটি কদম’। ঘাটাইলের মানুষও গবেষকদের মাধ্যমে তাদের অচিন গাছের নাম দিতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পান্ট ট্যাক্সোনোমিস্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের কাছে গাছটির বেশ কয়েকটি ছবি পাঠালে তিনি জানান, এই উদ্ভিদটি বটের কোন প্রজাতি হতে পারে, তবে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে নাম নিশ্চিত করা যাবে।
ঐতিহ্যবাহী ঘাটাইল উপজেলার একটি জনবহুল সাবেক সন্ধানপুর ইউনিয়নের আমুয়াবাইদ গ্রাম। চাপড়ি-মাকড়াই সড়কের দক্ষিণ পাশে এবং গারোবাজার-পোড়াবাড়ি সড়কের উত্তর পাশে এই ২০০ বছরের অচেনা গাছটি দাড়িয়ে রয়েছে। ঘাটাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান সামু’র বাড়ি থেকে প্রায় দুই হাজার গজ উত্তরে গাছটি অবস্থিত। এ ইউনিয়নের আমুয়াবাইদ নামক স্থানে রাস্তার পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা অচিন গাছটি এখন কালের সাক্ষী। ২০০ বছরের পুরনো গাছটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। অন্য যেকোনো গাছের সাথে কোনো ধরনের মিল না থাকায় টাঙ্গাইলসহ সারা দেশে মানুষের কাছে বৃক্ষটি অচিন গাছ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
এই অচিন গাছের নিচে এক সময় হাট বসত। অচিন গাছের নাম অনুসারেই হাটটির নাম ছিল অচিনতলা হাট। তবে হাটটি এখন বিলুপ্ত। গাছটির নামকরণের ব্যাপারে স্থানীয়দের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এ নামেই এখন প্রসিদ্ধ। গাছটির জন্য দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে টাঙ্গাইলের জনপদ। প্রাচীনতম এ গাছটি একনজর দেখার জন্য কৌতূহল নিয়ে ছুটে আসেন উৎসুক দর্শনার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের নবগঠিত সংগ্রামপুর ইউনিয়নের আমুয়াবাইদ গ্রামে হঠাৎ বড় অবস্থায় গাছটির সন্ধান পান স্থানীয়রা। তবে গাছটি কে বা কারা রোপণ করেছিলেন তা জানা যায়নি। গাছটি ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে আজ বিশালাকার ধারণ করেছে। ভিনদেশী গাছ হওয়ায় এবং দেশীয় প্রজাতির কোনো গাছের সাথে মিল না থাকায় স্থানীয়রা গাছটির নাম দেন অচিন গাছ। পরে এ নামেই গাছটি পরিচিতি লাভ করে।
গত ১২ আগস্ট’২৪ সোমবার সরেজমিনে গেলে কথা হয় অনেকের সাথে। আমুয়াবাইদ গ্রামের আব্দুস সামাদ (৮০), মো. হাতেম আলী (৭০), মো.আ.হালিম মিয়া (৬০) জানান, ছোটবেলা থেকে এ গাছটি এমনই দেখছেন তিনি। এমনকি তার বাবা মৃত তছির উদ্দিনের কাছে এ গাছের বয়স সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছেন। এই অচিন গাছে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পাখি বাস করে। বিশেষ করে টিয়া পাখির সংখ্যাই বেশী। বাপ-দাদারা বলেছেন, অনেকে মনেভারতের কুচার দেশ থেকে কেউ হয়তো যাদু করে গাছটি চালান করে দিয়েছিল। তবে এ কথা কেউ কেউ বিশ^াস করেন না। মনে না করলেও বাস্তবাতা এই যে, এ স্থানে স্থানীয়রা বড় অবস্থাতেই হঠাৎ করে গাছটির খোঁজ পায়।
আব্দুর রহিম মিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বৃহত্তর সন্ধানপুর ইউ.পির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম মিয়া জানান, গাছটির পাতা অনেকটা কাঠবাদাম গাছের মতো। এ গাছে ফুল হয় এবং ফুল থেকে ছোট এক ধরনের বীজ হয়। বীজ পড়ে গাছটির চার পাশে আরো কয়েকটি গাছের চারা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলে এ গাছের মতো কোনো গাছ তাদের নজরে পড়েনি। গাছের অত্যধিক বয়স হওয়ায় উপরি ভাগে ডালপালা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তবে গাছের নিচের অংশ এখনো রয়েছে সতেজ ও ডালপালায় ভরপুর। অনেক লোকজন গাছটি দেখতে আসেন। লোকজনের বসার সুবিধার্থে এবং গাছটি সংরক্ষনে সরকারি খরচে গাছের ঘোড়ার চারপাশে পাকা করে দেয়া হয়েছে।
শমসের ফকির ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও ছড়াকার সাজু রহমান জানান, ২৫-৩০ বছর আগে গাছটির দেখিছিলাম, আবার এখন দেখলাম। গাছটি যেন আগের মতোই রয়েছে। রাস্তার পাশ থেকে ছোট একটি চারা পকেটে ভরে নিয়ে যাচ্ছি, রোপন করব দেভি কেমন হয়।
এলাকাবাসীর দাবি, গাছটি ঘিরে ওই এলাকায় পর্যটনশিল্প গড়ে উঠতে পারে। গাছটি যেন বেঁচে থাকে আরো বহুদিন, তার সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন স্থানীয়রা। তাদের দাবী ২০০ বছর পরে হলেও যেন গাছটির একটি নাম দেয়া যায়। আর সেই সাথে গাছটির পাশে যে রাস্তা রয়েছে তা প্রশস্ত করে ও বৃক্ষস্থলের আশপাশে মাটি ভরাট করে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা যায় এখানে।